রামমোহন রায়ের স্বলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনী

রামমোহন রায়

“প্রিয়বন্ধু,

“আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত আপনাকে লিখিয়া দিবার জন্য আপনি আমাকে সর্ব্বদাই অনুরোধ করিয়াছেন। তদনুসারে আমি আহলা দের সহিত আমার জীবনের একটী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত আপনাকে লিথিয়া দিতেছি।

“আমার পূর্ব্ব পুরুষেরা উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন। স্মরণাতীত কাল হইতে তাঁহারা তাঁহাদিগের কৌলিকধর্ম্ম সম্বন্ধীয় কৰ্ত্তব্যসাধনে নিযুক্ত ছিলেন । পরে প্রায় একশত চল্লিশ বৎসর গত হইল, আমার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ ধর্ম্মসম্বন্ধীয় কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া বৈষয়িক কার্য ও উন্নতির অনুসরণ করেন। তাঁহার বংশধরেরা সেই অবধি তাঁহারই দৃষ্টান্ত অনুসারে চলিয়া আসিয়াছেন। রাজসভাসদিগের ভাগ্যে সচরাচর যেরূপ হইয়া থাকে, তাহাদিগেরও সেইরূপ অবস্থার বৈপরীত্য হইয়া আসিয়াছে ; কখন সম্মানিত হইয়| উন্নতি লাভ, কখনও বা পতন; কখন ধনী, কখন নির্ধন ; কখন সফলতালাভে উৎফুল্ল, কখন বা হতাশ্বাসে কাতর। কিন্তু আমার মাতামহ বংশীয়েরা কৌলিক ধর্ম্মানুসারে ধর্ম্মযাজক ব্যবসায়ী; এবং উক্ত ব্যবসায়ীগণের মধ্যে তাঁহাদিগের পরিবারের অপেক্ষা উচ্চতর পদবীস্থ অপর কেহই ছিলেন না। তাঁহারা বর্তমান সময় পর্যন্ত সমভাবে ধর্ম্মানুষ্ঠান ও ধর্ম্মচিন্তাতে অনুরত ছিলেন। সাংসারিক আড়ম্বরের প্রলোভন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগ্রহ অপেক্ষা, তাঁহারা মানসিক শান্তি শ্রেয়স্কর জ্ঞান করিয়া আসিয়াছেন।

“আমার পিতৃবংশের প্রথা ও আমার পিতার ইচ্ছানুসারে আমি পারস্ত ও আরব্য ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলাম। মুসলমান্ রাজসরকারে কার্য্য করিতে – হইলে উক্ত দুই ভাষার জ্ঞান একান্ত প্রয়োজনীয়। আমার মাতামহ বংশের প্রথানুসারে আমি সংস্কৃত ও উক্ত ভাষায় লিখিত ধর্ম্মগ্রন্থ সকল অধ্যয়নে নিযুক্ত হই; হিন্দু সাহিত্য, ব্যবস্থা ও ধর্ম্মশাস্ত্র সকলই উক্ত ভাষায় লিখিত ।

“ষোড়শ বৎসর বয়সে আমি হিন্দুদিগের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একখানি পুস্তক রচনা করিয়াছিলাম । উক্ত বিষয়ে আমার মতামত এবং ঐ পুস্তকের কথা, সকলে জ্ঞাত হওয়াতে আমার একান্ত আত্মীয়দিগের সহিত আমার মনাত্তর উপস্থিত হইল। মনাত্তর উপস্থিত হইলে আমি গৃহপরিত্যাগ পূর্ব্বক দেশভ্রমণে প্রবৃত্ত হইলাম। ভারতবর্ষের অন্তর্গত অনেকগুলি প্রদেশ ভ্রমণ করি। পরিশেষে বৃটিশাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশতঃ আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করিয়াছিলাম। আমার বয়ঃক্রম বিংশতি বৎসর হইলে, আমার পিতা আমাকে পুনর্ব্বার আহ্বান করিলেন; আমি পুনর্ব্বার তাঁহার স্নেহ লাভ করিলাম। ইহার পর হইতেই আমি ইয়োরোপীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ও তাঁহাদিগের সংসর্গে আসিতে আরম্ভ করিলাম। আমি শীঘ্রই তাঁহাদিগের আইন ও শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে এক প্রকার জ্ঞানলাভ করিলাম। তাঁহাদিগকে সাধারণতঃ অধিকতর বুদ্ধিমান, অধিকদৃঢ়তাসম্পন্ন এবং মিতাচারী দেখিয়া তাঁহাদিগের সম্বন্ধে আমার যে কুসংস্কার ছিল, তাহা আমি পরিত্যাগ করিলাম ; তাঁহাদিগের প্রতি আকৃষ্ট হইলাম। আমার বিশ্বাস জন্মিল, তাঁহাদিগের শাসন, বিদেশীয় শাসন হইলেও, উহাদ্বারা শীঘ্র দেশবাসীগণের অবস্থোন্নতি হইবে। আমি তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেরই বিশ্বাসপাত্র ছিলাম। পৌত্তলিকতা ও অন্যান্য কুসংস্কারবিষয়ে ব্রাহ্মণদিগের সহিত আমার ক্রমাগত তর্কবিতর্ক হওয়াতে এবং সহমরণ ও অন্যান্য অনিষ্টকর প্রথা নিবারণ বিষয়ে আমি হস্তক্ষেপ করাতে, আমার প্রতি তাঁহাদিগের বিদ্বেষ পুনরুদ্দীপিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল; এবং আমাদিগের পরিবারের মধ্যে তাঁহাদিগের ক্ষমতা থাকাতে, আমার পিতা প্রকাশ্যরূপে আমার প্রতি পুনর্ব্বার বিমুখ হইলেন। কিন্তু আমাকে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য প্রদত্ত হইত। আমার পিতার মৃত্যুর পর আমি অধিকতর সাহসের সহিত পৌত্তলিকতার পক্ষ সমর্থনকারীদিগকে আক্রমণ করিলাম। এই সময়ে ভারতবর্ষে মুদ্রাযন্ত্র সংস্থাপিত হইয়াছিল। আমি উহার সাহায্য লইয়া তাঁহাদিগের ভ্রমাত্মক মত সকলের বিরুদ্ধে দেশীয় ও বিদেশীয় ভাষায় অনেক প্রকার পুস্তক ও পুস্তিকা প্রচার করিলাম। ইহাতে লোকে আমার প্রতি এরূপ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল যে, দুই তিন জন স্কটলণ্ডবাসী বন্ধু ব্যতীত আর সকলেই আমাকে পরিত্যাগ করিলেন। সেই বন্ধুগণের প্রতি ও তাঁহারা যে জাতির অন্তর্গত তাঁহাদিগের প্রতি আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ।

“আমার সমস্ত তর্ক বিতর্কে আমি কখন হিন্দুধর্ম্মকে আক্রমণ করি নাই। উক্ত নামে যে বিকৃত ধৰ্ম্ম এক্ষণে প্রচলিত, তাহাই আমার আক্রমণের বিষয় ছিল। আমি ইহাই প্রদর্শন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, ব্রাহ্মণদিগের পৌত্তলিকতা, তাঁহাদিগের পূর্ব্বপুরুষদিগের আচরণের ও যে সকল শাস্ত্রকে তাঁহারা শ্রদ্ধা করেন ও যদনুসারে তাঁহারা চলেন বলিয়া স্বীকার পান, তাহার মতবিরুদ্ধ। আমার মতের প্রতি অত্যন্ত আক্রমণ ও বিরোধ সত্ত্বেও, আমার জ্ঞাতিবর্গের ও অপরাপর লোকের মধ্যে কয়েক জন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমার মত গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

এই সময়ে ইয়োরোপ দেখিতে আমার বলবতী ইচ্ছা জন্মিল। তত্ৰত্য আচার ব্যবহার, ধর্ম্ম ও রাজনৈতিক অবস্থাসম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞানলাভ করি বার জন্য স্বচক্ষে সকল দেখিতে বাসনা করিলাম। যাহা হউক, যে পর্যন্ত না আমার মতাবলম্বী বন্ধুগণের দলবল বৃদ্ধি হয়, সে পর্যন্ত আমার অভিপ্রায় কার্যে পরিণত করিতে ক্ষান্ত থাকিলাম। পরিশেষে আমার আশা পূর্ণ হইল। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নূতন সনন্দের বিচারদ্বারা ভারতবর্ষের ভাবী রাজশাসন ও ভারতবাসীগণের প্রতি গবর্ণমেন্টের ব্যবহার বহুবৎসরের জন্য স্থিরীক্বত হইবে, ও সতীদাহ নিবারণের বিরুদ্ধে প্রিভিকৌন্সিলে আপিল শুনা হইবে বলিয়া আমি ১৮৩০ সালের নবেম্বর মাসে ইংলণ্ড যাত্রা করিলাম। এতদ্ভিন্ন, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দিল্লীর সম্রাট কে কয়েকটি বিষয়ে অধিকার চ্যুত করাতে, ইংলণ্ডের রাজকর্ম্মচারিদের নিকট আবেদন করিবার জন্য, তিনি আমার প্রতি ভারাপণ করেন। আমি তদনুসারে, ১৮৩১ সালের এপ্রেল মাসে, ইংলণ্ডে আসিয়া উত্তীর্ণ হই।

“আমি আশা করি, এই বৃত্তান্তটি সংক্ষিপ্ত হইল বলিয়া আপনি ক্ষমা করিবেন; কেননা এখন বিশেষ বিবরণ সকল লিখিবার আমার অবকাশ নাই।

রামমোহন রায়।”

কুমারী কার্পেন্টর অনুমান করেন, রামমোহন রায় এই পত্রখানি তাঁহার কলিকাতাস্থ বন্ধু গর্ডন সাহেবকে লিখিয়াছিলেন। ইংলণ্ড হইতে ফরাসি দেশে যাইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে ইহা লিখিত হয় । প্রথমে ইহা এথিনিয়ম ও লিটারেরি গেজেট পত্রে প্রকাশিত হয়। পরে উহা হইতে অন্যান্য সংবাদ পত্রেও উদ্ধৃত হইয়াছিল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *